মো. রাজু লস্কর
চাচা কেমন আছেন? বাম হাতে ঝোলা আর পথ ঠাঁওয় করা লাঠি । ডান হাত ভিক্ষার জন্য সামনে বারিয়ে কচ্ছপ গতিতে এগিয়ে এসে আস্তে আস্তে বললো “এই আছি”। কি নাম আপনার? “ছডু”। “ছোড হাল থেইক্কা সবাই ছডুই কয়।” ভাল নাম কি ? “সুরেন্দ্র নাথ”। থাকেন কই? “বাজারে “। রোদ বৃষ্টি ঝড়েও বাজারে থাকেন?। হুম ওই মুরগির ঘর যেহানে ,ওইয়ার পাশে। প্রতিদিন আপনি ভাত খেতে পারেন? “ওই দুপুড়ে খাই ধরেন আইজ আমনের ঘরে কাইল আরাক জনের ঘরে “।মানে ! কয় বেলা ভাত খান? “এক বেলা” । আর প্রশ্ন করতে পারছিলাম না ভিতর থেকে আমার গলা কেমন যেন শুকিয়ে আসছিল। তারপরও, অতিমারি করোণা ভাইরাস সম্পর্কে জানতে চাইলাম? এবার কিন্তু নয়ন জুগল মেলে ছডু হাসলেন , মুখে মৃদু হাসির আভা মেখে বললেন , ” করুনা হেয়া আবার কি ?” আমি বললাম এটা এক ধরনের ভাইরাস জনিত রোগ। “করুনা মরুনা চিনিনা। গুটি বসন্ত হইছিল একবার । অনেক মানু মরছিল হেয়া দেখছি”। আমাদের অঞ্চলে কোন রোগ আসছে কিনা জানতে চাইলে ছডু বলেন,” হুনি বোলে ঢাকা চিটাগাং,নারায়নগঞ্জ একছের মানু মরে”। ভূমিহীন, দৃষ্টিহীন এরকম হাজারও ছডু হয়তো আসলেই জানেন না অতিমারি করোণা কি? এর প্রমাণ তার কথায় । এর প্রমাণ তার নাকে মুখে মাক্স নামক বেঁড়া না থাকায়। এরা লকডাউন মানেনা। বৃদ্ধ বয়সে ঔষধ কেনা, খাবার কেনা এসব কারনে এই নগ্ন পৃথিবীকে আকড়ে ধরতে ছডুদের হাত পাততে হয়। হাত পাততে হয় সে বেঁচে আছে বলে। জামার সব গুলো বুতাম খোলা তার। পাখির বাসার মত শ্বেত কেশ। মুখ ভরা দাঁড়ি আর গোঁফে। পরণে কোন রকম ছেঁড়া কাপড় । থালি পায় । আর এ সব দিয়ে কি হবে? মানবতাই যখন শিকল বন্ধি। তখন আর কি হবে পোষাক আর শরীর দিয়ে। যাক না সব রসাতলে। মানব জাতের লালারসে আজ অন্ধত্ব দাঁনা বেঁধেছে। তাইতো তারা , বয়স ভারে ক্লান্ত অন্ধ ছডুকে দেখেনা । তাইতো তারা বছরের পর বছর রাস্তায় থাকা ছুডুকে দেখেনা। শুনেছি ইটের ব্যবসা জমজমাট । ইট বালু সিমেন্ট মিশ্রিত কংক্রিট দিয়ে আকাশ ছোঁয়া বহু বিল্ডিং উঠছে এ দেশে । সে নিকেতনে ঢাঁই হয়না দাদুর বয়সি ছডুদের। আমরা সব চেইঞ্জ করে জীবন কে জয় করতে চলেছি অবিরাম। সে সাথে সাথে মানবতা মনুষ্যবোধ জলাঞ্জলি দিয়ে ফেলেছি। না হলে ছডুদের এ অবস্থা হতো না। ছডু`র বাড়ি বানারীপাড়া উপজেলার বাইশারী ইউনিয়নের ০৭ নম্বর ওয়ার্ডে । বয়সের দিক দিয়ে সে প্রায় শতবর্ষী । পরিবারে আর কেউ নেই। চোখে না দেখলেও , বাইশারী বাজার ও এর আশে পাশে রাস্তায় ,ভিক্ষা করতে করতে সব জায়গা প্রায় মূখস্ত তার। রবীন্দ্রনাথের মত কিছুটা দেখতে মনে হলেও আসলে তিনি ছডু। রাত পোহালে ভিক্ষা ,আর নি:শব্দ রাত হলে বাজারের কুকুর তার নিত্যসঙ্গী , এটাই তার বড় পরিচয়। তাই কবির ভাষার সাথে তাল মিলিয়ে বলতে ইচ্ছা করে “হে দারিদ্র তুমি ছডুকে করেছো মহান” । মাঝ বয়সেই আমাদের দেশের ধন কুবেরদেয় ডজন খানেক ডাক্তার আর নার্স লাগে । আর সে খানে প্রায় শতবর্ষী ছডু, অন্ধ ছডু একাই থাকেন রাস্তায় । গাঁয়ের চামড়া কুঁচকানো একাই চলেন ধরায় । ঢিলেঢালা চামড়ার ছডু কচ্ছপ গতিতে চালিয়ে যান ভিক্ষাবৃত্তি। নিজেকে এ বয়সেও টেককেয়ার করার ক্ষমতা দেখে যে কারো স্যালুট দিতে ইচ্ছা করবে ছডুকে। আর বলতে ইচ্ছা করবে ,জীবন যুদ্ধে আপনিই আসল মহানায়ক “ছডু”।
(লেখক;- গণমাধ্যম কর্মী,বানারীপাড়া ,বরিশাল। )
আন্তর্জাতিক, ইসলাম ও জীবন, বিনোদন, লিড নিউজ