শাকিব বিপ্লব/মাসুদ রানা : বরিশাল রাজনীতিতে সিটি মেয়র ও নগর আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহকে এই মুহূর্তে রহস্যময় পুরুষ হিসেবে ভাবা হচ্ছে। তার গতিবিধি বোঝা বড় দায়। কখন কি সিদ্ধান্ত নেন, তার চারপাশে থাকা রাজনৈতিক সহচরও আগাম অনুমান করতে পারছেন না। তবে দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গ বা ইজ্জতের প্রশ্ন দেখা দিলে অতি আস্তাভাজন অনুসারীকে আস্তকুরে নিক্ষিপ্ত অর্থাৎ সংগঠন থেকে বের করে দিতেও কুণ্ঠবোধ করেন না। এমনকি নিজের বাসভবনেও যাতায়াত বন্ধ করে দেন এক নির্দেশে। ইতোপূর্বে তার এধরণের পদক্ষেপের বহু উদাহরণ রয়েছে। সর্বশেষ ছাত্রলীগের সদর উপজেলা সভাপতি আশিকুর রহমান সুজনকে বহিষ্কারসহ কালীবাড়ি সড়কের নিজ বাড়ি আঙ্গিনায় প্রবেশে বিধি নিষেধ আরোপ করে প্রমাণ করে দিয়েছেন নিজের নয়, দলীয় স্বার্থে কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। এমন কঠোর ভূমিকায় অবতীন হওয়ায় ধরণ দেখে তার শিবিরে অনুসারী ও নেতাদের মধ্যে এক ধরণের আতঙ্ক ভর করেছে, চলছে সতর্কতার সাথে।
তার ঘনিষ্ঠ অনুগতরা নাম প্রকাশে অপরগতার শর্তে জানান, রাজনীতির শুরুতে তিনি উদারতা দেখিয়েছেন, কাছে টেনেছেন অনেকে। এক সময় তাকে এবং তার পরিবার নিয়ে কটুক্তি বা ব্যাঙ্গ করেছেন তাদেরও জায়গা দিতে দেখা গেছে। একটা ছিল তার রাজনৈতিক কৌশল মাত্র। মূলত সাবেক সিটি মেয়র ও নগর আ’লীগের কর্ণধর জনপ্রিয়তার শীর্ষ থাকা অবস্থা হঠাৎ মৃত্যু শওকত হোসেন হিরনের সহধর্মীনি রাজনীতির মাঝে নামলে মেয়র সাদিকের উত্থানে পথের কাটা হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু প্রায়ত নেতা হিরনপত্মী জেবুন্নেছা আফরোজকে প্রত্যাক্ষভাবে সহয়তা দেয়ায় বরিশাল আ’লীগে স্পষ্ট বিভাজন দেখা যায়। শুরু হয় মহানগর আ’লীগের নেতৃত্ব নিয়ে লড়াই।
এই সময়কালেই সাদিক আবদুল্লাহ রাজনৈতিক দুরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে জেবুন্নেছার শিবিরে ভাঙ্গন ধরতে চিহ্নিত কয়েকজন নেতা ব্যতিত অন্যান্য অনুসারীদের কৌশলে কাছে টেনে আনে। এর ফলে নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডের নেতৃত্বে থাকা নেতাকর্মীরা সাদিক আবদুল্লাহর অনুকূলে ভিরে এই অংশের আধিপত্য সৃষ্টিতে সহয়ক হয়। অনেক নেতাকর্মীর ভুল ত্রুটির ক্ষমা চোঁখে মার্জনা করেন। ধীরে ধীরে রাজনীতিতে বেশ পরিণত হলে সাদিক আব্দুল্লাহর কঠোর মানসিকতায় সংগঠনকে নিয়ন্ত্রণ শুরু করেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দাবি, যুব বয়সী সাদিক আবদুল্লাহ বরিশাল আ’লীগের শহর কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে একচ্ছত্র অধিপত্য পেলে আশঙ্কা যেকে ছিল রাজনৈতিক সন্ত্রাসে কীর্তনখোলার তীর এই জনপদ আবারও অশান্ত হয়ে সেই ৯৬ নব্বইয়ের শাসনামলের প্রতিছবি দেখা দিতে পারে। আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক অসিম দেওয়ানের কাউনিয়ার বাস ভবনে রাতে গোলাগুলির ঘটনায় সেই আশঙ্কা আরো জোড়ালো রূপ পায়। কিন্তু সাদিক আবদুল্লাহ অতীত অভিজ্ঞতা থেকে সেই ভুল পথে হাটতে চাইনি তার আগামীর রাজনৈতিক পথপরিক্রমার ভাবনা মাথায় রেখে। ধারণা, যে কারণে বরিশালের রাজনৈতিক সন্ত্রাস বিস্তার ঘটেনি। উল্টো সহবস্থানের রাজনীতি উপহার দিয়ে নিজেকে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন জেলা থেকে ঢাকায় ইতিবাচক আলোচনায়।
সংগঠনে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার পর ঘরের মধ্যেই শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করতে দেখা যায়। সেই পদক্ষেপে প্রথমেই তোপের মুখে পরে তার সবচেয়ে অনুগত ও ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে সার্বক্ষণিক সাথে এবং বাসভবনে অবস্থানকারী তারেককে কালীবাড়ি নিজ বাড়ি থেকে নকআউট করে দেয়ায়। এ ঘটনায় অনেকে বিস্মিত হয়েছিলেন, খুঁছিলেন নেপথের কারণ। এই তারেক সেই তারেক যে কি না একমাত্র অনুসারী ঘরোয়া প্রতিপক্ষ শওকত হোসেন হিরনের দাপটিও আমলে সাদিক আবদুল্লাহর ছবিসহ পোস্টার ব্যানার নগরীতে টানিয়ে এই নেতার বরিশাল রাজনীতিতে আগমনের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। একটি সূত্র জানায় একজন বাকেরগঞ্জের বাসিন্দা একজন ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দিতে সাদিক আবদুল্লাহকে ম্যানেজের নামে মোটা অংকের অর্থ নিয়ে বিষয়টি চেপে রেখেছিলেন। ঘটনাচক্রে সাদিক আবদুল্লাহর কান পর্যন্ত এই অভিযোগ গড়ালে তার আস্তাভাজন অনুসারী কাজী মনির উদ্দিন তারেককে নীতির প্রশ্নে একবিন্দু ছাড় দেয়নি, সময়ও নেয়নি। কালীবাড়ি সড়কে তার আসা বন্ধ করে তার কাছে থাকা সব দায়িত্ব নিজের আয়েত্বে নিয়ে নেন।
দেখা যায়, তারেকের সেই শূণ্যস্থানে নিয়ে আসেন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সুমন সেরনিয়াবাতকে। এই যুবক দীর্ঘদিন তার ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে এবং মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর বেসরকারি পিএস হিসেবে নিয়োগ দেন। কানাঘুষা চলছে, কোন এক কারণে সুমন সেরনিয়াবাতের মসনতও টালমাটাল হয়ে উঠে। যে কারণে সম্প্রতি মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর সঙ্গি হিসেবে তাকে আর সরাচর দেখা যাচ্ছে না। সেই স্থানে তার শ্যালক মিলনকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যাচ্ছে। হতে পারে তা সাময়িক।
সিটি কর্পোরেশনের অনেক কর্মকর্তা তার আস্তা অর্জনে নানা ত্যাগের উপমা উপস্থাপন করে মেয়রের কাছা-কাছি থেকে বেশ প্রভাব বিস্তার করে ছিলেন। জনশ্রুতি রয়েছে, মেয়রের কাছের লোক হিসেবে ক্ষমতা অপব্যবহার করায় তাদেরও করুণ পরিণতি বহন করতে হয়েছে।
এসব ঘটনার পাশাপাশি সময় ভেদে ঘরোয়াভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত অনেক তোসমতকারী ব্যক্তিদের ক্ষমতার অদল-বদল ঘটে, এমনকি মেয়রের বাস ভবনে যাওয়া বন্ধ করে দেয়া হয়।
সর্বশেষ বরিশাল সদর উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমান সুজন মেয়রের কাছা-কাছি এবং স্নেনধন্য হয়ে একের পর এক অপকর্ম করে শীর্ষ এই নেতার নাম ব্যবহার করে চলছিল। কথায় বলে ‘চোরের দশদিন গিরাস্তের একদিন’-প্রচলিত এই প্রভাব বাক্যের অনুকরণে সুজনেরও পতন ঘটলো সর্বাধিক করুণভাবে। দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের সামিল এরকম দুইটি ঘটনার মধ্যে বরিশাল জেলা প্রশাসকে কটুক্তি ও চরকাউয়া পল্লী বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে হামলার অভিযোগে সদর উপজেলার এই নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ নগর আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে যদিও জেলা রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত নন, তদপুরি দলের দায়িত্বশীল পদে থাকায় তার নির্দেশনার আলোকে গত ২৯ এপ্রিল সুজন ছিটকে পরে বহিষ্কার আর্দেশের মধ্যদিয়ে।
বহিষ্কৃত হয়ে সুজন দুই কুল হারালো। পদও গেল, মেয়রের সান্নিধ্য বঞ্চিত হয়ে এখন পলাতক আসামী পল্লী বিদ্যুতের মামলায়। রাজনীতির উত্থান পতনের খেলায় বরিশাল নগর আ’লীগের অনেক নেতা ক্ষমতার যৌলুস হারিয়েছেন মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর কঠোর ও নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। যা থেকে রেহাই পায়নি তারই পরিষদ সিটি কর্পোরেশনের বেশ কয়েকজন কাউন্সিলরও। দল ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলোর দাবি সাদিক আবদুল্লাহ প্রথমে মেয়র পরবর্তীতে নগর আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পিছপা হচ্ছে না। আবার নিজের মানসিকতা কাউকে বুজতেও দিচ্ছে না, তিনি কোন পথে হাটবেন আগামী দিন। ফলশ্রুতিতে এখন সতর্ক মেয়র সাদিক অনুসারীরা, নেতারও শঙ্কিত কখন কোন শাস্তির খড়ক নেমে আসে অপকর্মের ফল হিসেবে।
মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর এসব পদক্ষেপের মাঝে শুধু রাজনৈতিক দুরদর্শিতায় নয়, স্বচ্ছতার ছাপ স্পষ্ট করছেন। এতে প্রসংশিত হচ্ছেন উদিয়মান এই নেতা ও নগর পিতা। এমন অভিমত রাজনৈতিক বোদ্ধা মহলের।